এখন বৈশাখ মাস গাছে গাছে ভরা আছে মধু ফল আমে। কিন্তু মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে একটি আম গাছে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ডালছাড়া গাছের মধ্যখানে ধরেছে কয়েকশত আম। আর ব্যতিক্রমী ভাবে ধরা এ আম দেখেতে শিশুসহ অসংখ্য লোকের ভির হচ্ছে সেখানে।
এ ঘটনাটি ঘটেছে শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের পেছনে ওয়াহিদ মিয়ার বাড়িতে। প্রকৃতির নিয়মে সাধারণত গাছের ছোট ছোট ডালের অগ্রভাগে আম ধরে থাকে। কিন্তু সে নিয়মের ব্যাতয় ঘটিয়ে এই গাছের বড় একটি ডালের মধ্যভাগে যেখানে কোন শাখা প্রশাখা ছাড়াই এক ঝোপে ধরেছে কয়েকশত আম। আর এতে শিশু দের যেন আনন্দের শেষ নেই।
বাড়ির মালিক জানান, আমগুলো ধরার পর থেকে তাদের বাড়িতে উৎসুক জনতার ভীর হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক আম ঝড়ে পড়ে গেলেও এখন ঐ ঝোপে রয়েছে দেড়শতাধিক আম। স্থানীয় চেয়ারম্যান ভানু লাল রায় জানালেন, গাছ গাছালি কমে যাওয়ায় প্রকৃতির এসব রুপ নতুন প্রজন্মের শিশুরা দেখতে পারছেনা। এ ঘটনায় শিশুদের মধ্যেই কৌতুহল বেশি। তাই তিনি নিজেও এসেছেন তা দেখতে। আর দেখতে এসে অনেক শিশুরাও জানায়, তারা এ রকম আম ধরা দেখেছে প্রথম। সকলে মিলে গাছ লাগাবো গাছের পরিচর্যা করবো। আর এতে নতুন এই প্রজন্মের জন্য দেশ হয়ে উঠবে গাছ গাছরাতে ভরপুর।
মৌসুমি ফল দিয়ে কর্তা ব্যক্তিদের খুশি করে স্বার্থ উদ্ধারের পদ্ধতি অনেক দিনের। বর্তমানে এই খুশি বিষয়টি আদায় করতে নগদ অর্থ খরচ করতে হলেও ফল থেরাপি ধরে রেখেছে অনেকেই। এর একটি হল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত মৌসুমি ফল পাঠিয়ে থাকেন জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারগণ। অধিদপ্তরের প্রাঙ্গন এখন আমে ভার্তি। আম আসছে আর অফিসারদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে কাঁঠাল, খাসি, ইলিশসহ আরো অনেক কিছু।
জানা গেছে, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও জেলা শিক্ষা অফিসারগণ এ মৌসুমী ফল পাঠানোর কাজটা করে থাকেন। যে আম আসে তা বিভিন্ন কর্মকর্তাদের গাড়িতে তুলে দেয়া হয়।
যেসব কর্মকর্তা স্পট ভিজিট করতে বিভিন্ন এলাকায় যান তাদের জন্যই মৌসুমি ফলের ব্যবস্থা করা হয়। সম্প্রতি সাংবাদিকদের ছবি ও ভিডিওতে বিষয়গুলো ধরা পড়েছে।
ফলের রাজা আম এ কথাটি যথাযথই বাস্তব। ফলের মধ্যে এক আমেরই আছে বাহারি জাত ও বিভিন্ন স্বাদ।
মুখরোচক ফলের মধ্যে অামের তুলনা নেই। মৌসুমি ফল হলেও, এর স্থায়িত্ব বছরের প্রায় তিন থেকে চারমাস। এছাড়া ফ্রিজিং করে রাখাও যায়। স্বাদ নষ্ট হয় না। আমের ফলন ভালো হয় রাজশাহী অঞ্চলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলের অাম সবচে’ উন্নতমানের হয়।
সারা দেশে রাজশাহী জেলা থেকেই বেশি আম সরবরাহ হয়ে থাকে। আমের অন্যান্য জাত ছাড়াও বিশেষ করে রাজশাহীর ফজলি বিখ্যাত। ফজলি আম বাজারে আসে সবার শেষে। আকারেও যেমন বড়, স্বাদেও অদ্বিতীয়। তাই আমের রাজা বলা চলে ফজলিকে।
বাহারি অামের নাম
লেংড়া, ক্ষিরসাপাতি, সিন্দুরা, চোসা, রাজভোগ, গোপালভোগ, ফজলি, আম্রপালি, হাড়িভাঙ্গা, কাচামিঠা, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, দুধসাগর, গোবিন্দভোগ, গুলাবখাস, গুটি, সুন্দরী, বোম্বাই, মল্লিকা, লখনা, অাশ্বিনা,
হাড়িভাঙ্গা আমের নামকরণ
এক লোক আম খেয়ে হাড়িতে রেখে দেয়। কিছুদিন পরে ওই হাড়ি ফুঁড়ে অাত্মপ্রকাশ করে একটা চারাগাছ। আর চারাগাছ রূপান্তর হয় পরিপূর্ণ গাছে। তারপর সেই গাছে অাসে রূপবতী আম। তার স্বাদ কী যেইসেই? অমৃতের স্বাদ নিয়ে যে আমের আত্মপ্রকাশ ভাঙ্গা হাড়ি থেকে, তার নাম হয়ে গেল হাড়িভাঙ্গা।
ফজলি আম
ব্রিটিশ ভারতে মালদহ জেলার কালেক্টর রাজভেনশ ‘ফজলি’ নামকরণ করেন। এর আগে ফজলি আম ‘ফকিরভোগ’ বলে পরিচিত ছিল। বলা হয়, ফজলি বিবি নামে এক বুড়ির বাড়ি থেকে প্রথম এই জাতটি সংগৃহীত হয়েছিল। তিনি বাস করতেন বাংলার স্বাধীন সুলতানদের ধ্বংসপ্রাপ্ত গৌড়ের একটি প্রাচীন কুঠিতে। তার বাড়ির আঙিনায় ছিল একটি পুরনো আমগাছ। তবে এটি কোন জাতের, সে বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না তার। ফজলি বিবি গাছটির খুব যত্ন নিতেন। গাছটিতে প্রচুর আম ধরত। আমগুলো যেমন আকারে বড়, তেমনি সুস্বাদু। সেখানকার নির্জনবাসী ফকির-সন্ন্যাসীদের তিনি এই আম দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। সে জন্য ফজলি বিবি এই আমের নাম দিয়েছিলেন ফকিরভোগ।
কালেক্টর রাজভেনশ একবার অবকাশ যাপনের জন্য ফজলি বিবির কুঠির কাছে শিবির স্থাপন করেন। তার আগমনের খবর পেয়ে ফজলি বিবি ফকিরভোগ আম নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। ইংরেজ সাহেব সেই আম খেয়ে খুবই তৃপ্ত হন। ফজলি বিবির আতিথেয়তায় তিনি এতই খুশি হয়েছিলেন যে, ওই আমের তিনি নাম দেন ‘ফজলি’। তখন থেকে এই নাম মানুষের মুখে মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ডায়াবেটিক আম
আমের এই জাতটি ইদানিংকালের অাবিষ্কার। আমটি সুস্বাদু, সুমিষ্ট, রং, রস, আঁশহীন ও সুগদ্ধ মেশানো দৃষ্টি নন্দন। আকর্ষণীয় এই অভিনব জাতটি উদ্ভাবনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে গবেষণা করে তিনি উদ্ভাবন করেছেন ডায়াবেটিক বা বাউ আম-৩। এই আমে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কম বিধায় তা ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। এই আমের অাঞ্চলিক নাম হচ্ছে আম্রপালি।
আসলে আমাদের দেশে আমের বাহারি জাত হলেও, এসব আমের নামকরণ কোনটাই ঐতিহাসিক না। কেবল কিছু আমের নামকরণ বাণিজ্যিকভাবে হয়ে এসেছে। তাও সেই নামকরণগুলি অ্যাকাডেমিকভাবে হয়নি। লোকমুখে ছড়ানো নামগুলোই সবাই নিয়েছে।
কিছু সংক্ষিপ্ত নামকরণের নমুনা
ক্ষিরের মত মিষ্টি যে অামের স্বাদ তার নাম ক্ষিরসাপাতি। রানী যে আম খেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন, সেই আমের নাম রানীভোগ।
বিহারের এক ল্যাংড়া ফকিরের বাড়ি থেকে সংগৃহিত চারা গাছ থেকে যে আমের সন্ধান মিলে, তার নাম হয়ে যায় ল্যাংড়া।
যে আমটা কাচা থাকতে মিষ্টি হয়, পাকলে টক হয়ে যায় তার নাম কাচামিঠা।
দুধ ভাতের সাথে আম মিশিয়ে খেতে কে না পছন্দ করে? আমের ত্বক নরম ও মিষ্টি হলে সেই অাম মাখানো দুধ ভাতের মজাই অালাদা। দুধভাতের অামের নাম হয়ে গেলো দুধসাগর।
চোষা আম বাংলাদেশের না। ইন্ডিয়াতেই এর উৎপত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে পাওয়া যাবে সৃজনের শুরু থেকেই। যেমন মিষ্টি তেমনি এতে অাঁশের পরিমাণ শূন্যের কোঠায়। তাই হাতের তালুতে নিয়ে মর্দন করে, ভেতরের ত্বক জুস বানিয়ে খাওয়ার অভ্যাস ছোট বড় সবারই অাছে। এভাবে চুষে খাওয়া অামের নাম হচ্ছে চোষা অাম।
আবার অাঞ্চলিকতাভেদে কিছু আমের একাধিক নামও এসেছে মানুষের ব্যবহারে। যেমন ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে রশুনে আম বলা হয় এক জাতের আমকে। তার স্বাদ যেমনি হোক, রশুনের মত গন্ধ বলে তার নাম রশুনে আম। এভাবে প্রায় অামেরই অদ্ভুত নামকরণ হয়ে গেছে। মানুষ আম ভালোবাসছে, খাচ্ছে। ইদানীং আম ব্যবসায়ীরা আমে ফরমালিন দিচ্ছে, পত্রিকায় নিউজ হচ্ছে, আম খেয়ে মৃত্যু। তবু আমের বাজার থেমে নেই। আমাদের অবস্থা এই এখন, মরবো তো খেয়ে মরি। তবু আম নাহি ছাড়ি।